চট্টগ্রাম, ২৫ মে : চন্দনাইশ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এই উপজেলাটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড়ী ও সমতল ভূমির সন্নিবেশে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। চন্দনাইশের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রবাহমান। এই চন্দনাইশ ছিল পটিয়া উপজেলার একটি অংশ। ১৯৭৬ সালে পটিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে চন্দনাইশ থানার সৃষ্টি করা হয়। ১৯৮৩ সালের ২ জুলাই চন্দনাইশ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। কথিত আছে চন্দন ও আঁশ হতে চন্দনাইশ নামের উদ্ভব। এলাকাটি একসময় চন্দন গাছের উৎপাদন ও ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিলো। প্রাচীন জনপদ "চন্দনাইশ" নামের উৎপত্তি নিয়ে অধ্যাপক বদিউল আলম বলেন, চন্দন কাঠের নামানুসারে চন্দনাইশের নামকরণ করা হয়েছে। গবেষক পি. আর টমাস বলেছেন, প্রাচীন চিকন চাউল "চিনাইস" থেকে চন্দনাইশ নামের উৎপত্তি। তবে এ চন্দন অর্থ চন্দন কাঠ নয়। এটি একপ্রকার উপাদেয় সব্জি।এখানে চন্দন নামের সব্জির প্রাচুর্য ছিল। চন্দন সব্জির আঁইশ অত্যন্ত পুষ্টিকর ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ছিল। এখান হতে বিভিন্ন এলাকায় চন্দন এর আঁইশ রাপ্তানি করা হতো। তাই এলাকাটির নাম হয় চন্দনাইশ।
১৯৩৯ সালে চন্দনাইশের ঐতিহ্যবাহী মুফতি পরিবারের প্রধান কেন্দ্র বিন্দু মুফতি শফিউর রহমান (রহ) এর পিতা মারা গেলে তিনি বার্মা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং স্থানীয় জনগণ তাঁর অধিক খ্যাতি ও নামের প্রেক্ষিতে বার্মায় যেতে দেয়নি এবং তিনি ১৯৪১ সালে তার শিক্ষক মাওলানা নজীবুল্লাহ (রহ) এর প্রতিষ্ঠিত প্রায় বিলুপ্ত মাদরাসাটি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসাটি পুনঃ প্রতিষ্ঠা কিংবা নবজীবন দান করেন। তিনি ১৯৪৬ সাল হতে ১৯৫৭ পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। যদিও তিনি ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব পালন করলেও তার উস্তাদের সম্মানার্থে কখনো নিজেকে অধ্যক্ষ দাবী কিংবা পরিচয় দেননি। স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মহান পুরুষ অত্র মাদরাসার অধ্যক্ষ থাকা কালে তাঁর কর্মদক্ষতা ও খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর বিরোধিতা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। এদের পিছনে ইন্দন যোগাচ্ছিল তাঁর দুধ কলা দিয়ে পোষ্য কতিপয় নামধারী আলেম। তাদের কুমতলব ও ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে মুফতি শফিউর রহমান (রহ) সাথে সাথেই পদত্যাগ করেন। স্বার্থান্বেষী মহলের সাথে আপোষ না করে অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তাঁর বাড়ীর থেকে কিছু দূরে জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা নামে আরেকটি ইলমে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
হাশিমপুর ইসলামিয়া মুকবুলিয়া দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক ১৯৫৬ সালে দাখিল, ১৯৬২ সালে আলিম, ফাজিল এবং ১৯৮৩ সালে বিজ্ঞানের মঞ্জুরী লাভ করে। এরপরে ২০০৬ সালে মাদ্রাসাটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হয়, এবং ২০১৬ সালে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত হয়। অত্র দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিকভাবে কামিল পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত হয় ১৩ই এপ্রিল ২০২২ সালে। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরীব অসহায় ও এতীম ছাত্রদের জন্য ৩০ই জানুয়ারী ১৯৯২ সালে সমাজ সেবা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম কতৃক সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্যাপিটেশন গ্রান্ট প্রাপ্ত "কর্ণেল (অবঃ) অলি আহমদ (বীর বিক্রম) এতিমখানা" নামে এতিমখানা চালু করা হয়। ১৯৬০ সালে শাহ মজিদিয়া হেফজখানা নামে হেফজখানা চালু হয়। অত্র মাদরাসার EIIN (Education Institute Identification Number) হচ্ছে ১০৪১৮৭। আর MPO নং হচ্ছে ২১৭০৬২৩০১।
চন্দনাইশে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ -২০২৪ এ হাশিমপুর ইসলামিয়া মকবুলিয়া কামিল (এমএ) মাদ্রাসা শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছে। উল্লেখ্য এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চন্দনাইশ উপজেলার একমাত্র ও প্রথম কামিল মাদরাসা। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি উত্তর হাশিমপুর ডাকঘর - গাছবাড়িয়া তথা গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের বিপরীত পাশে অবস্থিত।
চন্দনাইশ উপজেলার প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাশিমপুর ইসলামিয়া মকবুলিয়া কামিল (এমএ) মাদ্রাসায় যারা পড়েছেন কুরআন হাদীসের দরস নিয়েছেন তাদের সংখ্যা এত বেশি যে তাদেরকে সংখ্যায়িত করা এখানে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ মুহাদ্দিস, প্রফেসর হিসেবে অনেক ছাত্রই আজ নিয়োজিত। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদেরকে কুরআন-হাদীসের পাশাপাশি ধর্মীয় ও আরবী শিক্ষা দেয়া, ইসলামী আদর্শ ও চেতনা জাগ্রত করা, আদর্শবান ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলা ছিলো দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাশিমপুর ইসলামিয়া মকবুলিয়া কামিল (এমএ) মাদ্রাসার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপুল সংখ্যক ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ইসলামী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সহ আরো অনেক কর্মীবাহিনী। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিষ্য দেশের বাইরেও অনেক ভাল ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত।উল্লেখ্য এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা নানাভাবে ধর্মীয় ও সামজিক ও রাষ্ট্রীয় নানাক্ষেত্রে খেদমত আন্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। এটা একটি সফল ও আদর্শ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন যারা।
(১) মাওলানা মুহাম্মদ নজিবুল্লাহ (রহ) (১৯৪১ইং------১৯৪৫ইং)
(২)মুফতি মাওলানা শফিউর রহমান (রহ) (১৯৪৬ইং-----১৯৫৭ইং)
(৩) মাওলানা ইসহাক (রহ) (১৯৫৭ইং--------৩১/০৫১৯৯৭ইং)
(৪)মাওলানা নুরুল ইসলাম (রহ), ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (০১/০৬/১৯৯৭ইং---------২৮/০২/১৯৯৮ইং)
(০৫) মাওলানা মুহাম্মদ জব্বার আল কাদেরী (০১/০৩/১৯৯৮ইং-------৩১/০১/২০০১ইং)
(০৬) মাওলানা নুরুল ইসলাম (রহ), ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (০১/০২/২০০১ইং----৩০/০৬/২০০২ইং)
(০৭) মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল আলম (০১/০৭/২০০২ইং--------বর্তমান)
প্রতি বছর হাশিমপুর ইসলামিয়া মুকবুলিয়া কামিল (এম এ) মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। সুবিশাল ক্যাম্পাস, সুনিবিড় পরিবেশ, সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনা, দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন, কম্পিউটার ল্যাব, সুদক্ষ শিক্ষক প্যানেল এ সকলের জন্য এই মাদরাসাকে করেছে উপজেলার অন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনন্য। বর্তমান অধ্যক্ষ মাননীয় মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল আলম সাহেবের সুদক্ষ পরিচালনায় এ মাদরাসা দিনদিন উন্নতির ও সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। দ্বীনি ইলম চর্চার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাশিমপুর মুকবুলিয়া কামিল (এম.এ) মাদরাসা জাতীয়ভাবে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে।
লেখক : কলামিস্ট।
সদস্য, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।
যুগ্মসচিব , বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan